Rishop-The beauty spot of North Bengal-রূপসী রিশপ

ডিসেম্বর এর কনকনে ঠান্ডায় যখন নির্জনে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে যাওয়ার আচমকা প্ল্যান টা হল, ভাস্কর, আমি, সুভাষ আর প্রশান্তদা দ্বিরুক্তি না করে একমত হলাম। কলকাতার কোলাহল কিছুদিন পর পরই অসহ্য হয়ে ওঠে আমার কাছে। আর পায়ের তলার সর্ষে আর মাথার কিলবিলে পোকা গুলো পাহাড়ের নাম শুনলেই নেচে ওঠে। হাতে সাকুল্যে ৫ টা দিন। তা হোক! কুছ্ পরোয়া নেহী বলে ২০ শে ডিসেম্বর শিয়ালদা থেকে পদাতিক এক্সপ্রেসে চড়ে বসলাম। গন্তব্য, পাইনের বন আর পাহাড়ের কোলে উত্তর বঙ্গের সুন্দরী গ্রাম রিশপ।

প্রথম দিন :

পদাতিক নির্দিষ্ট সময় এর থেকেও প্রায় এক ঘন্টা দেরিতে আমাদের নিউ-জলপাইগুড়ি স্টেশন এ পৌঁছে দিলো। এন.যে.পি নামটার মধ্যে এক অদ্ভুত অনুভূতি আছে সেই ছোটবেলা থেকে। প্রথম ট্রয়-ট্রেন এ করে দার্জিলিং যাবার অভিজ্ঞতা সারাজীবন মনে থাকবে। সেই প্রথম হিমালয়ের প্রেমে পরা।

New Jalpaiguri station
New Jalpaiguri Station

সময় নষ্ট না করে মোটামুটি দরদাম শেষে একটা মাহিন্দ্রা বোলেরো ঠিক করলো সুভাষ। মাথাপিছু হিসাব এ নয় ,পুরো গাড়ি টাই রিসার্ভ করতে হলো কারণ এমনিতেই আমরা দেরি করে পৌঁচেছি তাই কিছু বারতি খরচ করতেই হবে সময় বাঁচানোর জন্য।

 আমরা লাভা হয়ে যাবার রাস্তা ধরলাম। ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে গাজোলডোবা ছাড়িয়ে তিস্তা ব্যারেজে এসে পেট বিদ্রোহ ঘোষণা করল। গর্তে কিছু দিতেই হবে। গাড়ি থেকে নেমেই মুগ্ধ হলাম। ব্যারেজের জলে সুন্দরী কাঞ্চনজঙ্ঘার ঝলক দেখে। গর্বিত, অহংকারী। যেন অভ্যর্থনা জানালো।

Kangchenjunga view from Teesta barrage
Kangchenjunga view from Teesta Barrage

চা আর ভেজ মোমো গলাধঃকরণ করে উত্তর বঙ্গের অপূর্ব প্রকৃতি দেখতে দেখতে একসময় লাভা র রাস্তা ডানহাতে রেখে রিশপ এর পাথুরে এবরোখেবড়ো রাস্তায় পরলাম। উষ্ণতা ক্রমশ কমতে লাগলো।। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা ৮৫০০ ফিট হওয়ায় রিশপ উত্তর বঙ্গের অন্য অনেক পাহাড়ের চেয়ে শীতলতর। ঠান্ডা হাওয়া, পাইন বনের সৌন্দর্য আর রাস্তার ঝা৺কুনি উপভোগ করতে করতেই গাড়ি একসময় রিশপ পৌঁছালো।

এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার, যেহেতু শেষের কয়েক কিলোমিটার রাস্তা খুব ই পাথুরে আর উচু নিচু, মাহিন্দ্রা বোলেরো বা ইনোভা জাতীয় গাড়ি নেওয়াই ভালো।

এছাড়া আরও একটি জ্ঞাতব্য বিষয় জানিয়ে রাখা ভালো। লাভা থেকে রিশপ দুভাবে পৌঁছানো যায়। গাড়িতে ১১ কিমি পাথুরে রাস্তায়, অথবা জঙ্গলের এবড়োখেবড়ো পায়ে চলা পথে পায়ে হেঁটে। সময় লাগে মোটামুটি ঘন্টা দুয়েক। সে অ্যডভেন্চারের পথে আমরা অবশ্য যাইনি।

প্রথম দর্শনেই রিশপের প্রেমে পড়লাম। সামনে অবারিত কাঞ্চনজঙ্ঘা। শীতে প্রচুর পাখির আনাগোনা। প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে রিশপ এক কথায় স্বর্গ। নিঝুম পড়ন্ত দুপুরে পর্যটক থাকলেও কলরব নেই।

রিশপ আসার পথেই হোটেল এ ফোন করে চারটে ভেজ মিল এ ব্যবস্থা করতে বলেছিলাম।

আজ এখান থেকেই সূর্যাস্ত দেখার ইচ্ছে আমাদের। পথশ্রমে সবাই একটু ক্লান্ত। কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথায় জমে থাকা মেঘ সরে যেতেই সব ক্লান্তির অবসান , আর তার পর ?

 এখান থেকে ৩৬০ ডিগ্রী ভিউয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘায়  সূর্যাস্ত দেখার অভিজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। শুধু মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে থাকা। 

চা আর আড্ডার পর ডিনার সেরে বাইরে এলাম। মাথার ওপর ঝকঝকে তারা ভরা আকাশ। দূরে দূরে ঝিকিমিকি আলো, কনকনে ঠান্ডার কামড়।

হোটেলের রুমে ফিরেই পাহাড়ের গল্প চলতে লাগলো। আগামী দিন সকালের সূর্যোদয় দেখবার একরাশ আশা বুকে নিয়ে, ক্লান্ত শরীর টাকে বিছানায় দিতেই প্রশান্তদার নাকের আওয়াজ পেলাম।

দ্বিতীয় দিন :

ঘড়ির কাটায় ঠিক পাঁচটা বাজে। আমরা সবাই শীতবস্ত্র চাপিয়ে এক এক করে বেরিয়ে এলাম সেই মুহুর্তের সাক্ষী হবার জন্য।

পরিষ্কার আকাশের সামনে চির তুষারাবৃত পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম শৃঙ্ঘ আমাদের সামনে ধ্যানমগ্ন। এ এক অপূর্ব দৃশ্য , তখনো পুব-আকাশ চিরে সূর্যদেব প্রকাশ পাননি। কারুর মুখে কথা নেই ,সবাই নিজের নিজের মতো করেই এই মুহূর্তগুলোর সাক্ষী হতে চাইছে।

Kanchenjunga befor sunrise Rishop
Kanchenjunga befor sunrise Rishop

এরই মধ্যে ভাস্কর তার ট্রাইপড সাজিয়ে তৈরী। সুভাষ বলে উঠলো ডিসেম্বরের ঠান্ডা উপেক্ষা করে এইরকম প্রকৃতি পাবো বলেই তো এইসময় ছুটে আসা। প্রশান্তদার অভিজ্ঞতা একটু অন্যরকম , উনি আগেও এসেছিলেন কিন্তু প্রকৃতির এই রত্নভাণ্ডার দেখতে পাননি খামখেয়ালীর আবহাওয়ার জন্য।

দেখতে দেখতে প্রথম সূর্যের আলো কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথায়, তার পর এক এক করে কুম্ভকর্ণ ,পান্ডিম , কাবরু সহ কাঞ্চনজঙ্ঘার পরিবারের সবাই জ্বলে-উঠলো। অদ্ভুত এক দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে রইলাম আমরা সবাই।

First light of sun over Kanchenjunga
First light of sun over Kanchenjunga

আট-টা বাজতেই প্রশান্তদা সবার আগে তৈরী হয়ে ব্রেকফাস্ট অর্ডার করতে গেলেন আর আমরাও এক এক করে ওনাকে অনুসরণ করলাম। গরম গরম লুচি আর তরকারী সাথে দ্বিতীয় বারের চা শেষ করে আমরা চারজনে পা বাড়ালাম রিশপের সর্বোচ্চ পয়েন্ট টিফিন দারার উদ্দেশ্যে।

Kangchenjunga enrout Tiffin dara viewpoint rishop
Kangchenjunga enrout Tiffin dara viewpoint Rishop

পাইনের ফাঁকে ফাঁকে পায়ে চলা পথে টিফিন দারা পৌঁছতে প্রায় এক ঘন্টা সময় লাগলো। পুরো রাস্তাতেই পাইনের ফাঁকে আমাদের সাথে পথ চলল কাঞ্চনজঙ্ঘা। পথে আরো কিছু বেশ উৎসাহী পাহাড় প্রেমী মানুষজনের সাথে দেখা হল আর কথাও হল । ঝাঁকে ঝাঁকেই নীল আকাশের ক্যানভাসে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ মুগ্ধ করলো।

tiffin dara view point rishop
Tiffin Dara view point Rishop

 দুই ঘন্টা কাটিয়ে হোটেলের পথে পা বাড়ালাম। একটা ছোট্ট এডভেঞ্চারের স্বাদ পেলাম পুরো রাস্তাতে।

হোটেলে এসে ফ্রেশ হয়ে ডিমের ঝোল আর ভাত খেয়ে বাইরে এলাম। সামনে ছড়ানো ছিটানো বসার জায়গা। আকাশ পরিষ্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথায় রঙের খেলা দেখা যায় এখান থেকেই।

রিশপ থেকে ২.৫ কিমি দূরে শেউল গ্রামে অবস্থিত শিব বুদ্ধের মন্দির আমরা একটু বিশ্রাম নিয়ে ঘুরে এলাম। মন্দিরের আরাধ্য দেবতা প্রভউ বুদ্ধ আর ভগবান শিব। আসা যাওয়ার পথে ছোট বড় অজস্র ঝর্ণা। শীতকাল বলে জল খুব কম।

হোটেলে ফিরে ক্লান্তি কাটাতে চা এর জুড়িমেলা ভার।

দিনের শেষ আলোতেই আর একবার কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ দেখবো বলে সবাই একজোট হলাম। কাঞ্চনজঙ্ঘা স্বমহিমায় আমাদের দেখা দিলো। মন ভরে ক্যামেরা বন্দি করলাম।

আজ আমাদের শেষ রাত রিশপে। আগামীকাল ফিরে যাওয়া। চিকেন কারী আর রুটি সহযোগে ডিনার শেষ করে একে অন্যকে শুভরাত্রি জানালাম।

তৃতীয় দিন :

আজও ভোর ভোর উঠলাম কিন্তু আকাশের মুখ ভার। আমাদের সবার মনও বেশ ভারাক্রান্ত। সবাই ভেবেছিলাম আজ সকালেও প্রকৃতিকে স্বমহিমায় পাবো।

ওই ঠান্ডার মধ্যে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে চায়ের কাপ নিয়ে গল্প জুড়ে দিলাম। রিশপ আমাদের ফেরায়নি ,সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত সবটাই গত দুইদিন চোখ ভরে দেখেছি। আজ মেঘের কোলে ধ্যানমগ্ন কাঞ্চনজঙ্ঘার এক অন্য রূপ দেখলাম মনপ্রাণ ভরে।

ব্রেকফাস্ট শেষ , সুভাষ আর প্রশান্তদা সরাসরি এন.জে.পি পৌঁছনোর জিপ ঠিক করতে গেছেন জিপ স্ট্যান্ডে। দর কষাকষির জায়গা নেই, নির্দিষ্ট দাম ঠিক করা। আমাদের আজ সন্ধ্যাবেলার উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসে কলকাতায় ফেরা।

আমি আর ভাস্কর এই ছোট্ট মিষ্টি গ্রামটা ঘুরে বেড়াচ্ছি আর এখানকার মানুষজন-দের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করছি।

local people rishop
Local People Rishop

বেলা বাজলো ১২ টা , আমাদের গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে আছে হোটেল এর সামনে। আজ লাঞ্চ করেই বেরোবো, রাস্তায় ওই চা বিরতি শুধু।

গাড়িতে ওঠার আগে আর একবার সবাই কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ প্রত্যক্ষ করলাম…..খুশির মধ্যেও কেমন যেন মনটা ভার হয়ে উঠলো…..গাড়ির চাকা গরাতেই সুভাষ বলে উঠলো “আবার আসতে হবে….রিশপ”।

কি কি দেখবেন :

হানিমুন কাপল, বার্ড-ওয়াচার আর আমাদের মত পাগল দের জন্য রিশপ আদর্শ গন্তব্য।

দর্শনীয় স্থানের মধ্যে প্রধান অবশ্যই টিফিন দারা। পায়ে পায়ে হেঁটেই পৌঁছে যাবেন। জঙ্গলের পথ তাই লোকাল কাউকেই সঙ্গেই নিতে পারেন।

এছাড়া রয়েছে নেওড়া  ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক। যার একটি প্রবেশ পথ রিশপের দিক থেকে। কিন্তু পারমিট নিতে হয় লাভা থেকে। তাই যারা নেওড়া ভ্যালি ন্যাশনাল  পার্ক যাবার প্ল্যান নিয়ে রিশপ আসছেন, শিলিগুড়ি থেকে আসার সময় লাভা থেকে একেবারে পারমিট করিয়ে নিয়ে আসাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এছাড়াও রিশপের আশেপাশে প্রচুর দ্রষ্টব্য রয়েছে। হাতে সময় থাকলে দেখে নিতে পারেন লাভা, লোলেগাঁ ও কোলাখাম ইত্যাদি।

রিশপ যাবার সেরা সময় :

গ্রীস্ম কাল :

রিশপ আপনি সারা বছরই আসতে পারেন। বিভিন্ন ঋতুতে রিশপের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। কিন্তু সেরা সময় মার্চ থেকে জুন, এপ্রিল / মে রিশপে আছে ফুলের সমাহার। প্রায় সব রিসোর্ট বা হোমস্টের আঙিনা ছেয়ে থাকে রং বেরঙের ফুলে।

বর্ষা কাল :

শুধু বর্ষা কাল এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। ঘোলাটে আকাশ আর মেঘে ঢাকা থাকে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ। রাস্তাও থাকে ধ্বসপ্রবন।

শীত কাল :

মিড সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর। কাঞ্চনজঙ্ঘা তার সবটুকু উজাড় করে দেয় এই সময়ে। আকাশ থাকে মেরা ওয়ালা ব্লু।

কি করে পৌঁছাবেন :

আকাশ পথ :

প্লেনে করে বাগডোগরা এসে সেখান থেকে রিশপ যাওয়ার গাড়ি ভাড়া করতে পারেন।

ট্রেন পথ :

ট্রেন পথে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছে সেখান থেকে গাড়ি বুকিং করে রিশপ পৌঁছান।

সড়ক পথ :

রিশপ  পৌছানোর তিনটি রুট আছে শিলিগুড়ি / নিউ জলপাইগুড়ি থেকে। লাভা হয়ে ( দূরত্ব ১০৫.৯ কিমি , সময় লাগে প্রায় ৩.৩০ ঘন্টা) , কালিম্পং হয়ে ( দূরত্ব ১১০ কিমি , সময় লাগে ৪ ঘন্টা মত) , আর গরুবাথান হয়ে ( দূরত্ব ১২০ কিমি , সময় লাগে ৪.৩০ ঘন্টা).

শেয়ার গাড়িতে যেতে চাইলে এন.জে.পি. স্ট্যান্ড থেকে কালিম্পং / লাভা আর সেখান থেকেই আবার রিশপ।

কোথায় থাকবেন :

রিশপ নির্জন হলেও থাকার জায়গা অপ্রতুল নয়। প্রচুর হোটেল, গেস্ট হাউস, হোমস্টের ছড়াছড়ি। মোটামুটি সবগুলো থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। আমাদের হোটেল টা ছিল রিশপের মেন মার্কেট এরিয়ার শেষ প্রান্তে , অনেকটা ওপরের দিকে। কাঞ্চন ভিউ ট্যুরিস্ট লজ।


RISHOP PHOTO GALLERY


1 thought on “Rishop-The beauty spot of North Bengal-রূপসী রিশপ”

Leave a Comment