দুর্গা পুজোর মাস দুয়েক আগে থেকেই মাথায় একটা প্ল্যান ঘুরছিল। একদিন এক বন্ধুকে ফোন করে বললাম পুরো ব্যাপারটা । সেও যেন তৈরি হয়েই ছিল এরকম একটা প্রস্তাব এর জন্য, সঙ্গে সঙ্গে লুফে নিলো । তারপর আরও কয়েকজন বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করা হলো তারা যেতে রাজি কিনা, তাদের মধ্যে একজন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে গেল। ব্যাস আর কি লেগে পড়লাম ডুয়ার্সের সরকারি হোটেল বা লজগুলো নিয়ে গবেষণায় । আমাদের পুরো ট্যুরটাই জঙ্গলে কাটাব প্ল্যান ছিল, সেইমতো কোন লজ জঙ্গলের মধ্যে, কতটা নিরিবিলি পরিবেশ, এসব নিয়ে বেশ কিছুদিন গবেষণা চললো ।
আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দুটো রাত নাহলে অন্তত একটা রাত হলঙ বাংলোতে কাটানো । কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও হলঙ পাওয়া গেল না । কেন পাওয়া গেল না সেটা লিখতে গেলে এত সুন্দর ট্যুরটার অপমান করা হবে, তাই হলঙ এর প্রসঙ্গ বাদ দিলাম । শেষমেশ যা দাঁড়ালো তা হলো আমরা মোট ৫ রাত ওখানে থাকবো আর যেহেতু আমরা নিজেরাই গাড়ি নিয়ে যাব তাই যাওয়ার সময় রায়গঞ্জে ও ফেরার সময় মালদাতে একটা রাত থাকব।
কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি প্রযন্ত রাস্তার অবস্থা সম্বন্ধে যতটুকু জানতে পেরেছিলাম তাতে আমাদের মতো লোকের একদিনে ডুয়ার্স পৌঁছানো কোনো মতেই সম্ভব নয়, তাই রাস্তায় যাওয়া আসার মধ্যে একটা হল্ট দিতেই হতো । ২২/১০/২০২০ (মহা ষষ্ঠী) ভোরবেলা ৬টা নাগাদ আমরা রুবী মোড় থেকে যাত্রা শুরু করলাম । দুটো গাড়িতে ( একটা অলটো K -10 আর একটা ফোর্ড ফিগো ) মোট ৬ জন লোক আর ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ১০ টা ব্যাগ ছিল। এতগুলো ব্যাগ হবার কারণ আমরা Covid-19 (করোনা) নিয়ে সবরকম সতর্কতা মেনেই অতিরিক্ত বিছানার চাদর, বালিশের ঢাকা, সারাদিনের খাবার আর চা খাওয়ার জন্য গরম জল….যতটা সম্ভব সবকিছু নিয়েই বেরিয়েছিলাম । এছাড়া মাস্ক আর স্যানিটাইজার আরো কত কি যে নিয়েছিলাম তার লিস্ট করতে গেলে চিত্রগুপ্তের খাতা লাগবে ।
আমাদের আজকের রাস্তা ডানকুনি – বর্ধমান – মোরগ্রাম – ফারাক্কা – মালদা হয়ে রায়গঞ্জ, মোট দূরত্ব প্রায় ৪৫০ কিমি । নির্ধারিত সময়ের প্রায় ১ ঘন্টা বাদে শুরু করার ফলে আমরা ধরে নিয়েছিলাম সন্ধ্যের মুখে আমরা রায়গঞ্জ পৌঁছে যাব, কিন্তু রাস্তায় অতিরিক্ত দাঁড়ানো আর খারাপ রাস্তার জন্য রায়গঞ্জ পৌঁছাতে রাত ৯ টা বেজে গেল । রাস্তার যা অবস্থা আর ঘন ঘন জ্যাম, সব মিলিয়ে অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পর NH-34 দিয়ে ছোট গাড়ি চালানো খুব বিপদজনক সেটা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। তার ওপর চোখের সামনে কয়েকটা ঘটনা দেখে ( আমাদের সঙ্গেও ঘটেছিল, তবে সেটা এখানে লিখলে অযথা ভয় দেখানো হয়ে যাবে ) আমরাও বেশ একটু ঘাবড়ে গেছিলাম ।
অবশেষে রায়গঞ্জ পৌঁছে ডিনার করার সময় ঠিক হলো পরদিন আমরা ভোর ৫টায় বেরোব যাতে দুপুরের মধ্যে লাটাগুড়ি পৌঁছে যেতে পারি । ২৩/১০/২০২০ ( মহা সপ্তমী ) আজও প্রায় ৬টা বাজলো গাড়ি ছাড়তে । আজ সারাদিন ঘটনার ঘনঘটা চললো সকাল থেকেই । গুগলজেঠু (google map) ডালখোলাতে জাম দেখাচ্ছে বলে আমরা বোতলবাড়ির রাস্তা ধরলাম।
এরপর শুরু হলো আসল যাত্রা, ১১/১২ কিমি রাস্তার পুরোটাই রোলার কোস্টার রাইড করে অবশেষে আমরা কিষাণগঞ্জ এর কাছে পৌছালাম । কোথা থেকে যে আমাদের ২ঘন্টা পার হয়ে গেল টের পেলাম না । রাস্তাটা এতটাই খারাপ ছিল যে টেনশনে অন্য কিছুর খেয়াল ছিল না । সবাইকে অনুরোধ , ভুল করেও এই রাস্তা ধরবেন না, রাতের বেলা তো নয়ই, দিনের বেলাতেও নয় । এরপর আমরা আবার গিয়ে আটকালাম ইসলামপুরের জ্যামএ । এমন ভয়ঙ্কর জ্যাম যা পার হতে অনেকটা সময় নষ্ট হল।
আমাদের আজকের বুকিং আছে লাটাগুড়িতে, ঠিক হল যত দেরিই হোক সেখানে গিয়েই লাঞ্চ করা হবে, রাস্তায় কোথাও খাওয়ার থেকে ওটা অনেক সেফ। ইসলামপুরের পর থেকে রাস্তা মোটামুটি ভালো তাই গাড়িতে স্পীড তুললাম আমরা, শিলিগুড়ি বাইপাস দিয়ে গজলডোবা পৌঁছে ওখানে একটু দাঁড়িয়ে আগামী ২ দিনের রসদ তুলে নেওয়া হলো , কারণ আমাদের রিসোর্টটা একদম নিরিবিলি জায়গায় নেওড়া নদীর ধারে, ওখানে কিছুই পাওয়া যাবেনা তাই যা কিছু নেওয়ার নিয়ে চললাম রিসোর্ট সোনার গাঁও এর দিকে। ছবিতে যেমন দেখেছিলাম সামনাসামনি দেখে তারথেকেও বেশি ভালো লাগলো জায়গাটা।
লাটাগুড়িতে মূর্তির ধারে এখন এত বিলাসবহুল হোটেল হয়ে গেছে যে পুরো জায়গাটার আকর্ষণ অনেকটাই নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে, সেই তুলনায় সোনার গাঁও খুবই ভালো। সামনে দিয়ে নেওড়া নদী বয়ে যাচ্ছে আর পিছন দিকে পুরোটাই চা বাগান, সেখানে অজস্র ময়ূরের বাসা।
সন্ধ্যার মুখে ময়ূরের ডাকে পুরো এলাকা মুখরিত হয়ে যায়। রিসোর্টে পৌঁছেই লাঞ্চ করেই আমরা নেওড়া নদীতে সূর্যাস্তের অপূর্ব দৃশ্য দেখতে পেলাম। এরপর বাকিরা কিছুক্ষন বিশ্রাম নিতে গেল আর আমি গেলাম আশপাশটা একটু ঘুরে দেখতে।
সোনার গাঁও-এর একতলা কটেজ গুলোর পাশে একটু ভেতরে জায়গার সঙ্গে বেমানান একটি ছাদওয়ালা বাড়ি আছে। শুনলাম এটিও সোনার-গাঁও এর একজন পার্টনার এর, আগে সোনার গাঁও এর অতিথিরা ওখানেও থাকতেন। কিছুদিন আগেই উনি আলাদা হয়েছেন সোনার গাঁও থেকে। আমার নিজস্ব মতামত হলো এরকম জায়গায় গিয়ে কংক্রিট এর দোতলা বাড়িতে থাকার থেকে নিজের বাড়িতে থাকা ভালো।
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ আবার আমরা আমাদের কটেজের বারান্দায় বসলাম। চা, পাকোড়া আর আমাদের বিশেষ অনুরোধে বোরোলি মাছ ভাজার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন হোটেল কর্তৃপক্ষ কারণ আমাদের আড্ডা যেহেতু অনেক রাত অবধি চলবে তাই আমাদের অনুরোধে রাতের খাবার ( রুটি, সবজি আর চিকেন কারী ) ওনারা আমাদের ঘরেই দিয়ে গেলেন। আমাদের আড্ডা গড়ালো প্রায় রাত ১টা অবধি, তারপর যে যার ঘরে গিয়ে ঘুম দিলাম।
পরদিন ২৪/১০/২০২০ ( মহা অষ্টমী ) সকাল ৬টায় ঘুম থেকে উঠেই দৌড়ালাম নদীর ধারে, আগের দিন রিসোর্টের মালিক বলেছিলেন আকাশ পরিষ্কার থাকলে নাকি এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা ভালোই দেখা যায়। তখন ব্যাপারটা গুরুত্ব দিতে চাইনি, কিন্তু সত্যি সত্যি দেখা পেলাম । এটা যেন একটা বাড়তি পাওনা হয়ে রইল আমাদের কাছে।
প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর ঘরে ফিরে চা আর প্রাতরাশ (লুচি, তরকারি আর ডিমের অমলেট) করলাম। আজ পুরো দিনটাই এখানে থাকবো আমরা, দুপুরে নদীতে স্নান করব এমনটা আগে থেকেই ঠিক ছিল। ১১.৩০ নাগাদ আবার গেলাম নদীর ধারে, স্নান করার জায়গা সকালেই দেখে এসেছিলাম। আমার এক বন্ধু একটা গার্ডেন ছাতাও নিয়ে গেছিল কলকাতা থেকেই। ছাতা খাটিয়ে বসার (বন্ধু পত্নীদের জন্য) ব্যবস্থা হলো, সঙ্গের সব জিনিসপত্র ওদের জিম্মায় রেখে আমরা নদীর জলে গা ভাসালাম। নেওড়া নদীর হাঁটুজলে আমাদের হুল্লোড় দেখে বন্ধু পত্নীরাও সাহস করে এসে যোগ দিল, শুরু হলো বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ফটো তোলা, হুঁশ ফিরল যখন আবার পেটের মধ্যে ছুঁচো ডন দিতে শুরু করেছে । হোটেলে ফিরে আবার একবার স্নান করতে হলো নদীর বালি ধোয়ার জন্য। তারপর লাঞ্চ করে বিশ্রাম নিতে গেলাম সবাই। সেদিন সন্ধ্যার আড্ডায় বোরোলি মাছ পাওয়া গেলো না তাই শুধু চিকেন পাকোড়া সহযোগে সন্ধ্যাপর্ব টা কাটালাম। পরের দিনের গন্তব্য পানঝোরা।
২৫/১০/২০২০- মহা নবমী ভোরবেলা উঠে দেখলাম আকাশের মুখ ভার, অল্প অল্প বৃষ্টি হচ্ছে, এই আবহাওয়ায় কাঞ্চনের দেখা পাওয়ার কোনো চান্স নেই বুঝে আবার একটু ঘুমিয়ে নিলাম। তারপর সকাল ৯টা নাগাদ তৈরি হয়ে বেরোলাম পানঝোরার উদ্দেশ্যে, সুন্দর মখমলের মতো এন.এইচ. ৭১৭ ধরে মহাকাল হয়ে চাপড়ামারি রেল গেট পেরিয়ে অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই এসে পৌছালাম চাপড়ামারি জঙ্গলের প্রধান ফটকে।
এখানে আমাদের বুকিং এর কাগজ দেখিয়ে রেজিস্টারে নাম লিখে জঙ্গলে ঢুকতে হলো। প্রধান ফটক থেকে আমাদের ক্যাম্প এর দূরত্ব ৪ কিমি, পুরো রাস্তাটাই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। প্রধান ফটক থেকে ১ কিমি যাওয়ার পর ডানদিকে পড়লো চাপড়ামারি ফরেস্ট রেস্ট হাউস। এটি সরকারি আমলাদের জন্য সংরক্ষিত হলেও বনবিভাগের ওপর মহলে চেনাজানা থাকলে এখানে থাকা যায়।
এখানে থাকার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর বারান্দা থেকে সারাদিন সল্ট পিটটা দেখা যায়, ওখানে কখন কোন জন্তু জানোয়ার আসছে নজর রাখা যায়। আমাদের যেতে হবে বাঁদিকে, আরো তিন কিমি মতো রাস্তা। গভীর জঙ্গল দেখতে দেখতে আমরা সেই দিকে গাড়ি চালাতে লাগলাম আস্তে আস্তে, রাস্তা দেখে বোঝাই যাচ্ছে অনেকদিন এই দিকে লোকজন বিশেষ আসেনি, রাস্তার মাঝখানের আগাছা গুলো অবধি বেশ লম্বা হয়ে গেছে। মিনিট ৩০ লাগলো পানঝোরাতে আমাদের ক্যাম্পে পৌঁছাতে, অপূর্ব সুন্দর পরিবেশে অবস্থিত এই ক্যাম্পটির তিনদিকে জঙ্গল আর সামনে মূর্তি নদী বয়ে চলেছে , তার ওপারে ধানক্ষেতে ধান পেকে হলুদ হয়ে আছে , মাঝে মাঝে হাতির দল পাকা ধান খেতে হানা দেয় এপারের জঙ্গল থেকে, একটি পায়ে চলা রাস্তা নেমে গেছে নিচের গ্রামে, তার নামও পানঝোরা।
এখানকার মূল আকর্ষণ যেহেতু ৩ কিমি দূরের ওই সল্ট পিট আর তার পাশের ওয়াচ টাওয়ারটা তাই তাড়াতাড়ি লাঞ্চ সেরে আবার গাড়ি নিয়ে চললাম ফরেষ্ট রেস্ট হাউসের দিকে, যাতে আগে থেকে ভালো জায়গা দখল করতে পারি সেই উদ্দেশ্যে। ৩.৩০ নাগাদ ওয়াচ টাওয়ার এর সামনে গিয়ে দেখি তখনও সেখানে তেমন কেউ আসেনি, পানঝোরাতে আমাদের পাশের কটেজে এক ভদ্রলোক ছিলেন, শুধু তিনি এসে পৌঁছেছেন। ওয়াচ টাওয়ার গিয়ে দাঁড়ানোর পর দেখলাম কয়েকটা বাইসন সেখানে জল খাচ্ছে , এছাড়া কয়েকটি ময়ূর, সারস আর একটা বুনো শুয়োর ঘুরে বেড়াচ্ছিল সল্ট পিটে। এরপর যত সময় যেতে লাগলো বাইসনের সংখ্যা ততই বাড়তে লাগলো।
আগেরবার যখন এখানে এসেছিলাম সেবার হাতির দেখা পেয়েছিলাম অনেক দূর থেকে এক ঝলক, এবার হঠাৎ করেই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো ৩টে হাতি মা আর তার সঙ্গে দুটো বাচ্চা, একটা বাচ্চা খুবই ছোট দেখলাম। হাতি গুলো এসেই নুন খেতে শুরু করলো। কিন্তু আসল চমক দেখলাম এরপর জঙ্গলের বিভিন্ন দিক থেকে একটা দুটো করে হাতি বেরিয়ে জমা হতে লাগলো নুনিটার কাছে। দলপতি এসেই হুঙ্কার ছেড়ে বাইসন গুলোকে ওখান থেকে সরে যেতে বললো, কয়েকবার কথা না শোনায় বাইসন গুলোকে তাড়া করতেও দেখলাম দলপতিকে। হয়তো দলে অনেকগুলো বাচ্চা থাকাতেই সে এরকম করছিল।
বেশ কিছু ময়ূর আর বকেরও দেখা পেলাম , এক জোড়া ধনেশ পাখির ডাক শুনলাম অনেকক্ষন ধরে কিন্তু নজরে পড়ল না। সন্ধ্যা নামার মুখে আমরা আবার ফিরে এলাম পানঝোরাতে। সত্যি বলতে কি ফেরার সময় ওই তিন কিমি রাস্তা যেন আর শেষ হতে চাইছিল না , প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল ওই সল্টপিট এর দূরত্ব এমন কিছু না, যেকোনো সময় একটা হাতি অথবা বাইসন যদি পথ আটকে দাঁড়ায় তাহলে কি করব ? আমাদের এই ছোট্ট গাড়ি দুটো তো ওদের কাছে একটা খেলনা মাত্র। যাইহোক এইসব ভাবতে ভাবতে আমাদের ক্যাম্প এর নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।
যে নেপালি ছেলেটি রান্না করে তাকে বলাই ছিল বারবিকিউ এর ব্যবস্থা তৈরি রাখার জন্য, দেখলাম তারা তৈরি করেই রেখেছে সব কিছু। আমরা ঠিক করেছিলাম বারবিকিউ করব ক্যাম্পের সামনের খোলা জায়গাটায় কিন্তু বাধ সাধল আচমকা বৃষ্টি। শেষকালে ঠিক হলো যেখানে আদিবাসী নাচ হয় ওই ঢাকা জায়গাটায় করা হবে, সেইমতো আয়োজন করে ওখানেই সান্ধ্যকালীন আড্ডা বসল। ক্যাম্পের লোকজন বলে গেল সারাদিন মেঘলা থাকায় সোলার ঠিকমতো চার্জ হয়নি তাই রাতে বেশিক্ষন আলো থাকবে না ,আমরা যেন একটু তাড়াতাড়ি ডিনারটা করে ফেলি।
পরদিন (২৬/১০/২০২০-বিজয়া দশমী) সকালে উঠে আমাদের তো মাথায় হাত, প্রচন্ড জোরে বৃষ্টি হচ্ছে আর চারপাশে মেঘের যা ঘনঘটা সেই বৃষ্টি থামবে বলে মনে হচ্ছিল না। সারা রাত প্রচন্ড জোর বৃষ্টি হয়েছে , বেশ কয়েকবার টিনের চালে বৃষ্টির আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেছিল আমার , একবার মনে হচ্ছিল নিশিযাপন সিনেমাটার মতো আমরাও না এখানেই আটকে যাই। এরমধ্যেই ঠিক হলো আমরা তৈরি হয়ে থাকব, বৃষ্টি থামলেই আমাদের শেষ দুদিনের ঠিকানা সিসামারার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ব। বেলা ১০টা নাগাদ বৃষ্টির দাপট একটু কমতে আমরা রওনা দিলাম ফালাকাটা হয়ে জলদাপাড়ার দিকে।
সিসামারা রাইনো ক্যাম্প জলদাপাড়া জঙ্গলের একটি অংশ, এখান থেকে জলদাপাড়া জঙ্গলের গেট মাত্র ৫কিমি দূরে। এই ক্যাম্পটি সিসামারা নদীর বাঁধের একদম ধারে, সারাদিন আপনি বাঁধের ওপর ঘুরে বেড়াতে পারেন। ভাগ্য ভালো থাকলে নদীর ওপারে গণ্ডার, হাতি, হরিণ এর জল খাওয়ার দৃশ্য দেখতে পারেন। আমরা বেশ কয়েক বছর ধরে এই জায়গাটায় আসার প্ল্যান বানাচ্ছিলাম কিন্তু হয়ে উঠছিল না, তাই এই ট্যুরে প্রথম এখানকার বুকিং করেছিলাম।
সিসামারা রাইনো ক্যাম্পের সৌন্দর্যের বর্ণনা দিতে গেলে পাঠকরা ধৈর্য হারাবেন তাই আপনাদের জন্য ফটো দিলাম অনেকগুলো, সেগুলো দেখে আপনারাই যা বোঝার বুঝে যাবেন। সেই সঙ্গে বাড়তি পাওনা মিঠুন বাবুর ব্যবহার আর টুসি বৌদির রান্না।
কটেজের বারান্দায় বসেই আপনি নদীর ওপারে জলদাপাড়ার জঙ্গল দেখতে পাবেন, মাঝে মাঝে ময়ূর চোখে পড়বে, হোটেলের গেট দিয়ে সোজা ড্যাম এর ওপর উঠে ডানদিক-বাঁদিক ধরে হাঁটতে থাকুন অথবা নেমে যান নদীর ধারে। পরিষ্কার দুটো দিন কোথা দিয়ে কেটে যাবে টের পাবেন না। আর একটু সাহস করে যদি রাতে নদীর ধারে যেতে পারেন তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই। হোটেল থেকে সার্চ লাইট দেবে আপনাকে, সেটা নিয়ে নদীর ধারে যান জন্তু-জানোয়ার দেখার জন্য আর সাহসে না কুলালে হোটেলের বারান্দায় বসেও মাঝে মাঝে সার্চ লাইট জ্বালিয়ে দেখার চেষ্টা করতে পারেন।
এখান থেকে জলদাপাড়া জঙ্গলের জীপ সাফারি বুকিং করা যায়, হোটেল কর্তৃপক্ষ সামান্য কিছু পয়সা নেন তার জন্য।
পরের দিন (২৭/১০/২০২০-একাদশী) ভোর ৫টায় আমরা জলদাপাড়ার গেটে পৌঁছে গেছিলাম, আমরা আগের দিন বুকিং এর সময় শুনেছিলাম হোটেলের ছেলেটি বলেছিল আপনাদের গাড়ি সবার আগে জঙ্গলে ঢুকবে। দেখলাম সত্যি সত্যি আমাদের গাড়ি সবার আগে ঢুকলো, প্রথম গাড়ি নিয়ে জঙ্গলে ঢোকার সামান্য কিছু সুযোগ-সুবিধা বেশি পাওয়া যায় জন্তু-জানোয়ার দেখার ক্ষেত্রে তাই আমরা মনে মনে বেশ খুশি হলাম। ঢোকার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ৪০টা বাইসনের একটা দল চোখে পড়ল, সবাই তখন প্রাতরাশ করতে ব্যস্ত, কয়েকজন একটু বিরক্তি ভোরে আমাদের দিকে চেয়ে দেখল।
এরপর বেশ কয়েকটা জায়গায় ঘুরে আমরা হলঙ বাংলোর রাস্তা ধরলাম। বাংলোর কাছাকাছি একটা নালাতে চোখে পড়ল একটি গণ্ডার, বোধহয় সকাল সকাল সূর্য প্রণাম করছিল, আমরা এসে ব্যাঘাত ঘটালাম। এরপর হলঙ বাংলোর সামনে গিয়ে সেখানেও একটি গণ্ডার দেখলাম। আর হলঙ বাংলোটাকে বাইরে থেকে দেখে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটালাম। এই লেখা লেখার সময়ও মনে মনে প্ল্যান করছি কবে ওখানে গিয়ে কয়েক রাত কাটানো যায়।
সাফারি শেষ করে কটেজে ফিরে বাকি দিনটা আমরা আশপাশে ঘুরে কাটালাম। পরদিন আমাদের বাড়ি ফেরার পালা, সন্ধ্যার আড্ডায় পরের দিনের প্ল্যানিং করা হল, আমরা মালদায় একরাত থেকে পরদিন কলকাতা ফিরব। অনেক রাত অবধি আমরা সেলিব্রেট করলাম, বিশেষ করে সাম্প্রতিক Covid-19 ( করোনা ) আবহে জীবনটা যেমন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল সেটা থেকে একটু হলেও মুক্তি পেলাম কয়েকটা দিন সবুজের মাঝখানে কাটিয়ে, সেই আনন্দে মেতে উঠলাম।
যাওয়ার আগে আমরা নিজেদের গাড়িতে গেছিলাম শুধুমাত্র Covid-19 ( করোনা ) পরিস্থিতির জন্য। সবথেকে ভালো হচ্ছে ট্রেনে যাওয়া। যদি আমাদের মতো লাটাগুড়ি দিয়ে শুরু করতে চান তাহলে নিউ জলপাইগুড়ি অবধি ট্রেনে এসে সেখান থেকে গাড়ি নেওয়া যায়। নিউ মাল জংশন নেমে সেখান থেকেও লাটাগুড়ি যেতে পারেন, সেক্ষেত্রে গাড়ির খরচ একটু কমবে। আর জলদাপাড়া দিয়ে শুরু করতে চাইলে হাসিমারা নামতে হবে অবস্থান্তরে ফালাকাটা, আলিপুরদুয়ার এই স্টেশন গুলোতে নেমেও জলদাপাড়া যাওয়া যায়।
ডুয়ার্স এর জঙ্গলে ঘোরার জন্য শুরু থেকে শেষ অবধি গাড়ি রেখে দিলে আশপাশের অনেক জায়গাই একবারে ঘুরে নেওয়া যায়। লাটাগুড়ি থেকে গরুমারা জঙ্গলে সাফারি করতে পারবেন। পানঝোরাতে থাকলে সারাদিন ওয়াচ টাওয়ারেই কাটান, সেদিন অন্য কোথাও না গেলেও চলবে। সিসামারা থেকে সময় পেলে জয়ন্তী ঘুরে নিতে পারবেন।
আমরা ৫ রাত ছিলাম ডুয়ার্সে, হাতে সময় থাকলে আর কয়েকটা দিন বাড়িয়ে নেওয়া যায়। চেষ্টা করবেন সরকারি জায়গাগুলো বুকিং করার, অবস্থানগত দিক থেকে দেখলে সরকারি কটেজ গুলো সব থেকে ভালো আর ব্যবস্থা অতি উত্তম। বুকিং করার সময় https://www.wbtdcl.com আর https://wbsfda.org এই দুটি ওয়েবসাইটে গিয়ে জায়গা পছন্দ করুন। বুকিং করার জন্য একটা আইডি বানাতে হবে তবেই বুকিং করা সম্ভব।
এখানে কটেজ ইনচার্জ / কটেজ মালিকের মোবাইল নং দেওয়া আছে, সরাসরি কথা বলে আপনার চাহিদা অনুযায়ী ঘোরার জায়গা ঠিক করতে পারেন। এই তিনটি জায়গায় যোগাযোগ করার জন্য রিসোর্ট সোনার গাঁও : +91 82404 69945 , পানঝোরা ওয়াইল্ডারনেস ক্যাম্প : +91 97337 22212 (অমিত ছেত্রী) , জলদাপাড়া রাইনো কটেজ : +91 98323 86826 / +91 62943 37955 (মিঠুন সরকার)