Singalila Pass Trek via Uttarey-Phalut-সিঙ্গালিলা পাস হয়ে ফালুট

আমরা কয়েকজন পাহাড় পাগল মিলে বছরে একবার অন্তত ট্রেকিং এ যাই। জানুয়ারি মাস এলেই একটা দিন ঠিক করে সবাই একজোট হয়ে প্রোগ্রাম বানিয়ে ফেলি (এমনিতেও সারা বছর ঘোরাঘুরির আলোচনা চলতেই থাকে), তারপর নির্দিষ্ট দিনে বাঁধন ছিড়ে বেরিয়ে পরা। গত বছর (২০১৯) এপ্রিল মাসের ২১ তারিখ রাতের পদাতিক এক্সপ্রেস ধরে নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছলাম। এখান থেকে আমরা আজ উত্তরে গ্রামে গিয়ে থাকব আর আমাদের ট্রেকিং শুরু হবে আগামীকাল সকাল থেকে।

UTTAREY VILLAGE
UTTAREY VILLAGE

আমাদের গন্তব্য সিঙ্গালিলা পাস হয়ে ফালুট সেখান থেকে গোরখে, এই ট্রেকিং রুটের জন্য গাইড ও পোর্টার আমরা কলকাতা থেকে আগেভাগে ঠিক করে এসেছি। নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছে ভারি ব্রেকফাস্ট করে আমরা রওনা দিলাম প্রায় ১৭০ কি.মি. দূরে উত্তরের উদ্দেশ্যে। একটু দরদাম করে একটা গাড়ি রিসার্ভ করা হলো। ১০.৪৫ এ রওনা দিয়ে করোনেশন ব্রিজ , মেল্লি , জোরথাং , লেগশিপ হয়ে যখন উত্তরে পৌছালাম তখন সন্ধ্যা ৬.১৫ বাজে। রাস্তায় বেশ কয়েকবার দাঁড়িয়ে খানাপিনা করাতেই আমাদের সময় একটু বেশি লেগে গেছিলো।

HOTEL-UTTAREY
HOTEL- UTTAREY

গাইড নিমাজি আমাদের অপেক্ষাতেই ছিলেন , নিয়ে গেলেন আমাদের সেই রাতের আস্তানাতে। উত্তরে একটা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম , উচ্চতা ৬৬০০ ফিট , বেশ ঠান্ডা ছিল ওখানে। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর একটু হাঁটাহাঁটি করে সোজা লেপের নীচে গিয়ে ঢুকলাম।

পরদিন (২৩/০৪/২০১৯) সকালে আমাদের গন্তব্য আচালে,দূরত্ব ৮ কি.মি. , রাস্তাটা পুরোটাই প্রায় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এবং সিকিমের জঙ্গলে জোঁকের উপদ্রব আছে এটা মোটামুটি সবাই জানেন।রুটি আর আলুর তরকারি খেয়ে আমরা যখন হাঁটা শুরু করলাম তখন ১০.৩০ বাজে। শুরুতে বেশ খানিকটা রাস্তা গ্রামের মধ্যে দিয়ে গিয়ে গুমফাদাড়া টপ পেরিয়ে আমরা পৌছালাম তেনজিং-হিলারি পার্ক এ। সেখানে কিছুক্ষন সময় কাটিয়ে আবার আমরা হাঁটা শুরু করলাম। এবার রাস্তাটা চড়াই আর ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। জঙ্গল এতই ঘন যে পর্যাপ্ত রোদ্দুরের অভাবে এপ্রিল মাসেও স্যাঁতস্যাঁতে আর কাদায় ভরা যা কিনা জোঁক থাকার জন্য আদর্শ। কিছু জায়গায় রাস্তা এতই পিচ্ছিল যে গাছের ডাল বা ওয়াকিং স্টিক এর ভরসায় পার হতে হলো।

ACHALEY CAMP SITE
ACHALEY CAMP SITE

আমরা আড্ডা-গল্প প্রিয় বাঙালি , নিরভেজাল আড্ডা ছাড়া আমাদের চলে না সে সিকিমের ঘন জঙ্গলে হোক বা পাড়ার মোড়ে , তাও আবার পাহাড়ের বন্ধুদের সঙ্গে যাদের সারা বছরে এই সময়টাতেই পাওয়া যায় , তাই একটু ফাঁকা জায়গা পেলেই আড্ডা আর পাহাড়ের গল্প , সময় কোথা দিয়ে কেটে যায় বোঝাই যায় না। যাইহোক এইসব করে যখন আচালে ক্যাম্প সাইটে গিয়ে হাজির হলাম তখন দুপুর ২.৪০ বাজে। আমাদের গাইড আর পোর্টাররা তাঁবু খাটিয়ে রান্নার ব্যাবস্থা করেছে , লাঞ্চ এ আজ ম্যাগী আর ব্ল্যাক কফি রাতে দেশি মুরগির ঝোল আর ভাত , আরে মশাই বাঙালির আড্ডা-গল্প যেমন প্রিয় তেমনি খাওয়াদাওয়াটাও সমান প্রিয়।

কিছুটা দূরে কয়েকটা রঙিন তাবু দেখা যাচ্ছে ,পরিচিতি পর্ব সেরে জানতে পারলাম শিলিগুড়ি থেকে আসা একঝাঁক তরুণ যাদের গন্তব্য দাফেভির পাস। তারা দেখলাম আমাদের থেকেও লোভনীয় খাবারের আয়োজন করেছেন।

আচালে থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা গেলেও আমরা পৌঁছানোর আগে থেকেই চারপাশ মেঘে পুরো ঢেকে যাওয়াতে আমাদের খুব অল্পক্ষণের জন্যই সেই সৌভাগ্য হয়েছিল। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর প্রথম দিন হাঁটার ক্লান্তি দূর করতে যে যার তাঁবুতে গিয়ে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে পড়লাম।

পরদিন (২৪/০৪/২০১৯) সকালবেলা সূর্যোদয় এর সঙ্গে সঙ্গে কাঞ্চনজঙ্ঘায় রঙের খেলা দেখা গেল। আজ আমরা হাগেপানি , থুলধাপ হয়ে যাবো কালিঝার , দূরত্ব ৭ কি.মি.।

ব্রেকফাস্ট এ লুচি আর আলুর তরকারি খেয়ে হাঁটা শুরু করলাম ঘড়ির কাটা বলছে সকাল ৮.৩০। আজও রাস্তা জঙ্গলের মধ্যে দিয়েই তবে কালিঝার এর একটু আগে থেকে জঙ্গল শেষ হবে জানালো আমাদের গাইড নিমাজি।

THULO DHAP BETWEEN ACHALEY AND KAILJHAR
THULO DHAP BETWEEN ACHALEY AND KAILJHAR

থুলধাপ (থুলে মানে বড় আর ধাপ মানে জায়গা) সুন্দর একটা ভ্যালি এখানে একটা রাত বিশ্রাম নেওয়া যায় তবে এখানে রাত কাটালে আর  কালিঝার এ থাকার দরকার পড়েনা।

থুলধাপ এ কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম কালিঝার এর দিকে। এখান থেকে পুরো রাস্তাটাই চড়াই ভাঙতে হবে আমাদের,তবে রাস্তাটা খুব বেশি লম্বা নয় এটাই একটু স্বস্তির কথা। প্রথম দিন আচালে আসার সময় রাস্তায় খুব বেশি রডোডেনড্রন না পেলেও আজ পুরো রাস্তায় অনেকরকম রডোডেনড্রন দেখতে পেয়েছি। কালিঝার পৌঁছানোর ঠিক আগেই একজায়গায় দেখা পেলাম ভারতীয় সেনাবাহিনীর , ওনাদের প্রশ্নের জবাবে আমরা যখন বললাম-আমরা পাহাড় ভালোবাসি তাই এত কষ্ট করে পাহাড়ে আসি তখন ওনাদের অভিব্যক্তি দেখে মনে হলো বেশ একটু অবাক হয়েছেন। ওনাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটার পর পৌঁছে গেলাম কালিঝার (৩৫৫০ মি:) সময় তখন দুপুর ১২ টা। 

KALIJHAR CAMP SITE
KALIJHAR CAMP SITE

কালিঝার জায়গাটা একটা পাহাড়ের টপ , এখান থেকে  কাঞ্চনজঙ্ঘা পরিষ্কার দেখা যায় , এর একটু ওপরে ফোকতেদাড়া , ৩০ মিনিট এর হাঁটা পথ এবং দেখা যায়  ফোকটে দ্বারা। সেখান থেকে সূর্যোদয় এর দৃশ্য কালিঝারকেও হার মানায়। যেহেতু আমরা দুপুরবেলাতেই পৌঁছে গেছি তাই অনেকটা সময় পাওয়া গেলো গল্পগুজব করার। এরমাঝে দুপুরে রুটি সবজি আর রাত এ গরম গরম খিচুড়ি ডিম ভাজা দিয়ে ভোজনরসিক বাঙালিরা ভোজন সারলাম।

পরদিন (২৫/০৪/২০১৯) ভোর ৫.৩০ এ আমরা প্রত্যেকে তৈরি হয়ে নিলাম বহু আকাঙ্খিত কাঞ্চনজঙ্ঘার মাথায় সূর্যোদয়ের এর দৃশ্য দেখবো বলে। আগেরদিন পুরো মেঘে ঢাকা থাকলেও সকালে আকাশ ঝকঝকে , স্লিপিং বুদ্ধ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। সূর্যোদয় দেখতে দেখতেই আমরা খাওয়াদাওয়া করে তৈরি হয়ে নিলাম আমাদের বহুকল্পিত সিঙ্গালীলা পাস পার হয়ে ফালুট যাওয়ার জন্য। আজকের রাস্তায় বেশ কিছুটা চড়াই ভাঙতে হবে তাই একটু সকাল সকাল রওনা হলাম। ঘড়ির কাটায় ঠিক ৮.৫০ আমরা হাঁটা শুরু করলাম সিঙ্গালীলা পাস এর উদ্দেশ্যে। প্রথমে ৩০ মিনিট পাহাড়ের রিজ ধরে হাঁটার পর শুরু হলো চড়াই । আজকের পুরো রাস্তাটাই ভারত এবং নেপাল উভয় দেশের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে যদিও এখানে কোনো কাঁটাতার এর চোখরাঙানি নেই । বেশ কিছু কংক্রিটের পিলার যার একদিকে ভারত আর অন্য দিকে নেপাল লেখা , দেখে বুঝতে পারলাম আমরা বিদেশ ঘেঁষে চলেছি। রাস্তায় কখনো ঝকঝকে রোদ্দুর তো কখনো পুরো হোয়াইটআউট , এইভাবে মেঘ-রোদ্দুর এর খেলা দেখতে দেখতে ১০.৪৫ নাগাদ আমরা সিঙ্গালীলা পাস পৌছালাম।

খাদ্যপ্রেমিক হিসাবে আমার একটু আধটু সুনাম আছে তাই সুনাম বজায় রাখার চেষ্টায় একবাক্স জলভরা সন্দেশ নিয়ে গেছিলাম সিঙ্গালীলা পাস এ বসে খাবো বলে , পুজো দেওয়ার পর সেগুলোর যথাযথ সদ্ব্যাবহার করে শুরু হলো উৎরাই। এখান থেকে তরীফুলে (নেপাল) অবধি পুরো রাস্তাটাই উতরাই। তারপর আবার ফালুটের এর সেই চড়াই ভাঙতে হবে। সকাল ১১.৩০ স্বপ্নের সিঙ্গালীলা পাস কে বিদায় জানিয়ে আমরা আবার হাটা শুরু করলাম তরীফুলের উদ্দেশ্যে। তরীফুলে একটা বুগিয়াল মতো জায়গা যেখানে কেক , বিস্কুট আর চকলেট দিয়ে লাঞ্চ সেরে পা বাড়ালাম ফালুট এর দিকে। দুপুর ১.৩০ নাগাদ পৌঁছে গেলাম ফালুট। এখানে আমাদের ট্রেকার্স হাট বুকিং করা আছে। আজ চড়াই উৎরাই ভেঙে প্রায় ১১ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ ৫ ঘন্টায় পেরিয়ে এলাম।

PHALUT TREKERS HUT
PHALUT TREKERS HUT

ফালুটে ট্রেকার্সহাট এ ঢোকার কিছুক্ষনের মধ্যেই শুরু হলো প্রচন্ড শিলাবৃষ্টি , সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রাও বেশ কয়েক ডিগ্রী নেমে গেল। ঘন্টাখানেক পর বৃষ্টি থামলে আশপাশটা একটু ঘুরতে বেরোলাম , ১৭ বছর পর ফালুট এলাম। ২০০২ সালের সঙ্গে এখনকার পার্থক্য বলতে একটা ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাম্প আর সান্দাকফু যাওয়ার চওড়া রাস্তা চোখে পড়লো। ট্রেকার্স হাটটাও এক রকমই আছে ঘর গুলোর আকার বদল হয়েছে আর বাথরুমটা একটু বদলেছে। তবে ১৭ বছর আগে যে ডরমেটরিতে ছিলাম সেটা আর খুঁজে পেলাম না। ব্যবস্থাপনা আমাদের মতো ট্রেকারদের কাছে অতি উত্তম। একটা লেপ আর একটা কম্বল আছে সব বিছানায় , রাতে জ্বালানোর জন্য মোমবাতি দেওয়া আছে সব ঘরে। এখানে একটি অল্প বয়সী সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো, নাম অনুরাধা, ট্রেকার্স হাট এর কেয়ারটেকার এর মেয়ে। মিরিকে কলেজে পরে , এখানে ছুটিতে এসে বাবা মায়ের কাজে সাহায্য করছে। এখনো তার সঙ্গে মাঝে মাঝে পাহাড়ের খবর বিনিময় হয়।

SINGALILA TOP
SINGALILA TOP

পরদিন ভোর ৫টায় ( এলার্ম বাজেনি , আমি অন্তত শুনতে পাইনি ) উঠলাম, কারন ১ কিমি চড়াই ভেঙে উঠতে হবে ফালুট টপে সূর্যোদয় দেখতে যাওয়ার জন্য। আমরা গতকাল যে রাস্তা দিয়ে এসেছি সেই রাস্তায় উঠে আরো বেশ খানিকটা ওপরে ফালুট-টপ , এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় এর দৃশ্য ভোলবার নয় , সঙ্গে উপরি পাওনা এভারেস্ট , মাকালু আর লোৎসে

একটা চোরতেন আছে বাহারি পতাকা লাগানো , ভয়ঙ্কর হাওয়ার দাপটে মনে হয় পতাকা গুলো উড়ে যাবে, হাওয়ার বেগ এতটাই বেশি যে হওয়ার দিকে মুখ করে কিছু বলতে গেলে শব্দ গুলো মুখের মধ্যেই জড়িয়ে যায় , সঙ্গীদের ডাকলেও তারা ১০ ফুট দূর থেকে ডাক শুনতে পায়না। প্রায় ২ ঘন্টা কাটিয়ে ফিরলাম ট্রেকার্স হাটে। আর তৈয়ারী শুরু হলো গোরখে যাওয়ার।

GTA-HUT-GORKHEY
GTA-HUT-GORKHEY

আমার মতে পশ্চিমবঙ্গের সব থেকে সুন্দর গ্রাম হলো গোরখে , তাই এখানে ২দিন ট্রেকার্স হাট বুক করাছিল আমাদের। আজকের রাস্তা পুরোটাই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে নিচে নামা আর ১৫ কিমি লম্বা। প্রচুর রডোডেনড্রন দেখতে দেখতে প্রায় ঘন্টাখানেক পর এসে পৌছালাম আলুবাড়ি নামক একটা জায়গায়।

জঙ্গলের মাঝে একটুখানি ফাঁকা জায়গা সেখানেই একটা নতুন ট্রেকার্স হাট তৈরি হতে দেখলাম , ভবিষ্যতে হয়তো এখানে থাকার ব্যবস্থা হবে। এখানে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে আবার চলা শুরু হলো , পুরো রাস্তাটাই উৎরাই , ফলে হাঁটুর ওপর ভালোই চাপ পড়ছিল।

এই রাস্তায় আমি এসেছি প্রায় ১৭ বছর আগে দুর্গাপুজোর সময় , তখন ঠান্ডা অনেক বেশি মনে হয়েছিল ( জীবনের প্রথম ট্রেক বলেও হতে পারে ) , এবার এসেছি এপ্রিল মাসে তাই পুরো রাস্তাতেই হরেক রকম রডোডেনড্রন দেখতে পেয়েছি।

হাঁটতে হাঁটতে যত গোরখে কাছাকাছি আস্তে লাগলো ততই মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো। সেই ১৭ বছর আগে দেখা গ্রামটা এখনো একই রকম সুন্দর আছে নাকি সভ্যতার কাছে হার মেনেছে সেই চিন্তা হতে লাগলো।যতই এগোতে থাকি ততই পুরোনো স্মৃতির ভিড় জমতে থাকে মনের মধ্যে , আগের বার ১০ জন এসেছিলাম , এখানে ২দিন এর হাট বুকিং করাছিল , দ্বিতীয় দিন এখানে আমাদের বড়াখানা হয়েছিল। সেই দলের দুএকজন ছাড়া সবাই প্রায় ট্রেকিং ছেড়ে দিয়েছে। বড়াখানার মেনু ছিল দেশী মুরগির ঝোল আর ভুট্টার আটার রুটি। যেহেতু তখন আমরা সবাই কলেজে পড়ি , সবার কাছেই পয়সার আধিক্য কম ছিল তাই আমরা কয়েকজন ৩টে সিকিম গোল্ড ব্রান্ডি দিয়ে কাজ সেরেছিলাম।

স্মৃতির ভিড় সরিয়ে এবারের কথায় আসি , ১২.৩০ নাগাদ দূর থেকে দেখা গেল গোরখে গ্রাম। ঘরবাড়ি বেড়ে যাওয়ায় একটু সৌন্দর্য কমলেও এখনো একইরকম সুন্দরী আছে আমার প্রিয় গোরখে। এমনকি ডি.জি.এইচ.সি. এর ট্রেকার্স হাটটাও একইরকম আছে। পাশে একটি নতুন বাড়ি হয়েছে আর একটি কংক্রিটের রাস্তা উঠে গেছে। গোরখের এই না বদলানোর কারণ মনেহয় এখনো কোনো গাড়ির রাস্তা তৈরি না হওয়া , ফালুট হয়ে আস্তে হয় অথবা ভারেঙ হয়ে গোরখে যেতে গেলেও ৪কিমি হেঁটে আসতে হয় , তাই সাধারণ মানুষের আনাগোনা কম।

ট্রেকার্স হাটে ব্যাগ রেখেই ছুটলাম গোরখে নদীতে স্নান করতে , কনকনে ঠান্ডা বরফ গলা জলে আমাদের মধ্যে ৩ জন স্নান করলাম , স্নানের সময় ঠান্ডা লাগলেও তারপর অপরিসীম আরাম পেলাম। তারপর দুপুরের খাওয়া সেরে বাকি সময়টা পাখির ছবি তুলে কাটলো , এখানে অজস্র পাখি দেখা যায় সারাদিন , ভার্ডইটার ফ্লাইক্যাচার , ওয়াগটেল , রক পিজিওন , লাফিং থ্রাশ , রেড স্টার্ট আরো কতরকম যার নাম আমি জানিনা। দ্বিতীয় দিন প্রায় পুরোটাই কুয়াশায় ঢাকা রইল আর বৃষ্টি হলো , তেমন কোথাও ঘোরাঘুরি করার সুযোগ পেলাম না। পরদিন সকাল ৮.১৫ নাগাদ হাঁটা শুরু করলাম গন্তব্য শ্রীখোলা বা সিরি খোলা , খোলা বলতে এখানে নদীকে বোঝায়।

আজ প্রায় ১৮ কিমি পথ , যার বেশিরভাগটাই গতকালের মতো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। ট্রেকার্স হাটের পাশ দিয়েই রাস্তা উঠে গেছে সোজা সামানদেন গ্রাম এর দিকে। সামানদেন আরো একটা ছবির মতো সুন্দর গ্রাম , চারপাশ জঙ্গলে ঘেরা , অল্প কয়েকটা ঘরবাড়ি যার কয়েকটা হোমষ্টে করেছেন ওখানকার বাসিন্দারা। ভারেঙ-গোরখে হয়েই এখানে আসতে হয় , কেউ যদি এইটুকু কষ্ট করে আসেন ( ভারেঙ থেকে সামানদেন ৫-৬ কিমি রাস্তা , তবে আসার সময় গোরখে অবধি স্থানীয় কাউকে রাস্তা দেখানোর জন্য নিয়ে আসলে সুবিধা হবে ) কথা দিচ্ছি হতাশ হবেন না। নিরিবিলিতে দুটো-তিনটে দিন অনায়াসেই কেটে যাবে। অসংখ্য পাখির দেখা পাবেন আর পাহাড়ি পথে হেঁটে বেড়াতে পারবেন।

সামানদেন থেকে হাঁটা শুরু করে প্রায় দেড়ঘন্টা পরে এসে পৌছালাম রাম্মাম গ্রামে। এখানে একটা ফুটবল মাঠ আছে পাশেই এক দাজুর দোকান , সেখানে চা আর ভুট্টার দানা ভাজা খেয়ে খানিক বিশ্রাম নিয়ে আবার হাঁটা শুরু। এখন রাম্মাম অবধি গাড়ি আসে , তাতে লোকাল লোক ছাড়া আর কেউ আসে বলে মনে হয় না , তবে একটা ভাঙাচোরা রাস্তা তৈরি হয়ে গেছে। আমাদের গন্তব্য শ্রীখোলাতেও গাড়ির রাস্তা এসে পোঁছে গেছে এটা কলকাতায় থাকতেই শুনেছি।

রাম্মাম থেকে শ্রীখোলা পুরোটাই উৎরাই , যেতে যেতে দেখলাম অনেক জায়গাতেই রাস্তা চওড়া করা হচ্ছে গাড়ি যাওয়ার জন্য। মনের মধ্যে চিন্তা উঁকি দিলো গাড়ির রাস্তা হয়ে গেলে জায়গাগুলো এমন সুন্দর থাকবে তো ! নাকি এখানেও ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠবে অসংখ্য হোটেল , আর সান্দাকফুর মতো অসংখ্য শুড়িখানা ? এইসব ভাবতে ভাবতে দুপুর ১.৪৫ নাগাদ পৌঁছে গেলাম শ্রীখোলা। এখানেও আমরা ট্রেকার্স হাট বুক করে রেখেছিলাম কলকাতা থেকেই।

মালপত্র রেখে নদীর ধারে যেতে না যেতেই আবার বৃষ্টি শুরু হলো। এখানেও প্রচুর পাখি দেখা যায় তাই অপেক্ষা করে রইলাম কখন বৃষ্টি থামবে। দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর সেই সুযোগ এলো। সন্ধে নামার আগে অবধি নদীর ধারে অনেক পাখির ছবি তুললাম। কাল সকালেই আমাদের ফিরতে হবে শিলিগুড়ি , সেখান থেকে রাতের পদাতিক এক্সপ্রেস ধরে কলকাতা। আবার একটা বছরের অপেক্ষা সবাই মিলে পাহাড়ে হাঁটতে বেরোনোর।

বি:দ্র: সিঙ্গালীলা পাস যাওয়ার বেশ কয়েকটা রাস্তা আছে তারমধ্যে উত্তরে হয়ে (আমরা যে রাস্তায় গেছিলাম) এবং হিলে-ভার্সে-দেওলিঙ্গালী ধাপ-কালিঝার-সিঙ্গালীলা পাস-ফালুট-গোরখে-শ্রীখোলা এই দুটি রাস্তায় বেশি প্রচলিত।

অভিজ্ঞ গাইড ছাড়া জঙ্গলে রাস্তা ভুল হবার সম্ভাবনা আছে সুতরাং কেউ নিজেরা যাওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। এপ্রিল-মে মাসে গেলে প্রচুর ফুল দেখতে পাবেন তবে মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা থাকে , তাই হাতে অন্তত এক থেকে দুদিন সময় বেশি রাখুন।

উত্তরে থেকে কালিঝার অবধি রাস্তায় জোঁক পাবেন অনেক তাই সঙ্গে নুন অথবা নস্যি রাখুন। গোরখে এবং শ্রীখোলার রাস্তাতেও কিছু জায়গায় জোঁক আছে। হিলে-ভার্সে রাস্তায় জোঁকের উৎপাত বেশি। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে গেলে ঠান্ডা একটু বেশি থাকলেও আকাশ পরিষ্কার থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এই রাস্তায় খুব বেশি ট্রেকার পাবেন না তাই প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র সব কিছুই নিজের সঙ্গে রাখুন।

-: সিঙ্গালিলা পাস ট্রেক করবার জন্য সেরা সময় :-

গ্রীস্ম কাল :

এই পথে ফুলের শোভা দেখতে গেলে আপনাকে আস্তে হবে এপ্রিল-মে মাসে। এই সময়ে মাঝেমাঝে কুয়াশা আর বৃষ্টি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

বর্ষা কাল :

বর্ষাকালে (জুন মাস থেকে) এই রাস্তায় কোনোরকম ট্রেক করা যায় না।

শীত কাল :

সিঙ্গালীলা পাস যাওয়ার সেরা সময় আমার মতে সেপ্টেম্বর এর শেষ থেকে অক্টোবর অবধি। এই সময় গেলে আপনি রডোডেনড্রন দেখতে পাবেন না কিন্তু রোজই ঝকঝকে সুন্দর আবহাওয়া পাবেন।

-: কিভাবে যাবেন :-

আকাশ পথ :

প্লেনে করে বাগডোগরা এসে সেখান থেকেও উত্তরে যাওয়ার গাড়ি ভাড়া করতে পারেন।

ট্রেন পথ :

ট্রেন পথে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছে সেখান থেকে গাড়ি বুকিং করে উত্তরে অথবা হিলে পৌঁছান।আপনি যদি গাইড আগে থেকেই ঠিক করে আসেন তাহলে সে আপনার সঙ্গে এই দু জায়গাতেই দেখা করে নেবে।আর গাইড এর সঙ্গে আগে থেকে যোগাযোগ না করে এলে সেক্ষেত্রে উত্তরে বা হিলেতে একটা দিন অতিরিক্ত রাখুন গাইড ও পোর্টার ঠিক করা , রেশন ও কেরোসিন তেল জোগাড় করা আর সবজি , ডিম,অন্যান্য টুকিটাকি প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য।

সড়ক পথ :

নিউ জলপাইগুড়ি থেকে উত্তরে প্রায় ১৬৫ কিমি দূরে,যেতে অন্তত ৮ ঘন্টা লাগবে।এক থেকে তিনজনের দল হলে শেয়ার গাড়িতে যেতে পারেন খরচ কমানোর জন্য,সেক্ষেত্রে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে শেয়ার গাড়িতে জোরথাং গিয়ে আপনাকে উত্তরে না হিলের শেয়ার গাড়ি ধরতে হবে। আমার মতে একটা ট্রেক শুরু করার আগে যদি রাস্তাতেই আপনি অর্ধেক এনার্জি শেষ করে ফেলেন তাহলে ট্রেক শুরুর আগে আপনার শরীর পুরোপুরি বিশ্রাম পাবে না।তাই সম্ভব হলে গাড়ি বুকিং করেই আসুন।

-: কোথায় থাকবেন :-

উত্তরেতে থাকার বেশ কয়েকটি হোটেল ও হোমস্টে আছে। মাথাপিছু ২০০ টাকার বিনিময়ে থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

ফালুট , গোরখে আর শ্রীখোলাতে থাকার জন্য সল্টলেকের সিটি সেন্টার মল এর উল্টোদিকে গোর্খা ভবন থেকে ট্রেকার্স হাট বুক করতে পারেন। ডরমেটারি সজ্জা প্রতি ২৫০/- টাকা।দ্বি-সজ্জা , চার শয্যা বিশিষ্ট ঘর ও পাওয়া যায় কিছু জায়গায়।

আচালে আর কালিজার এ থাকার একমাত্ৰ ব্যবস্থা হলো তাঁবু। আপনি যদি নিজে জোগাড় নাও করতে পারেন তাহলে আপনার ঠিক করা গাইডকে বলুন সেই সব করে রাখবে। এখন এই রাস্তায় বেশিরভাগ গাইড প্যাকেজ এ নিয়ে যেতে চায় তারা আপনাকে তাঁবু , ম্যাট , পোর্টার আর চারবেলা খাবার দেবে , তার বিনিময়ে প্রতিদিন মাথাপিছু ওরা একটা টাকা ধরে নেবে (আনুমানিক ২০০০টাকা)। সেক্ষেত্রে আপনাকে শুধু জামাকাপড় আর স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে যেতে হবে।


SINGALILA PASS TREK PHOTO GALLERY


Leave a Comment